রোদ আর ছায়া ঠিক যেন দুটো ছোট্ট ছেলে। দুজনেই খুব বন্ধু। সারাদিন ছোটাছুটি, হুটোপাটি, দৌড়ঝাঁপ লেগেই আছে। ওদের প্রিয় খেলা লুকোচুরি। কখনো রোদ লুকিয়ে থাকে, কখনো ছায়া লুকিয়ে পড়ে। মাঠে রোদ এলে, ছায়া লুকিয়ে যায় ঝাপসা গাছের নিচে। নদীর জলে রোদ চিকচিক করলে, ছায়া ঘাপটি মেরে থাকে ঘাটে বাঁধা নৌকোর ভেতর। বাড়ির বারান্দায় ছায়া পড়লে, রোদ লুকোতে পালায় ছাদে। জানলা দিয়ে রোদ ঘরে উঁকি দিলে ছায়া খাটের তলায় ঢুকে মুখ টিপে হাসে। কেউ যদি গরমের দুপুরে ছাতা নিয়ে পথে বেরোয়, রোদ আর ছায়ার খুব মজা হয়। ছায়া টুক করে ঢুকে যায় ছাতার তলায়। রোদ ছাতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্ধুকে ধরতে যায়। পারে না। তবে ছাতা যেই বন্ধ হয়, ছায়া পড়ে বিপদে। তাকে বেরিয়ে আসতে হয়। রোদ তখন খপ করে চেপে ধরে বন্ধুকে। দুজনেই হেসে ওঠে।
শুধু খেলা নয়। রোদ আর ছায়া দুজনে মিলে দুষ্টুমিও করে খুব। বাড়ির ছাদে রোদের পিসিমা হয়তো ভিজে জামা কাপড় শুকাতে দিয়েছেন, আকাশে খানিকটা মেঘ নিয়ে এসে ছায়া সেই ভিজে জামা কাপড়ের উপর পড়ল ঝাপাস করে। ব্যস, জামাকাপড় আর কিছুতেই শুকোতে চায়না। রোদের পিসিমা তো রেগে আগুন। তেমন আবার ছায়ার মামা হয়তো দুপুরে ছায়ায় শুয়ে “ফুড়ুৎ, ফুড়ুৎ'' আওয়াজ করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলেন। রোদ পা টিপে টিপে এসে তেরচা ভাবে পড়ল ঠিক মুখের ওপর। ছায়ার মামা ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙে উঠে বসলেন। গাঁট্টা পাকিয়ে তেড়ে গেলেন রোদের দিকে। রোদ ততক্ষণে পগারপার।
এই রোদ ছায়ার একদিন খুব ঝগড়া হল। তখন গরমকাল। বেজায় গরম। গনগনে রোদ। গরম বাতাস। আকাশ যেন একটা আগুন ভর্তি করায়। নদী-নালা শুকিয়ে কাঠ। জলের অভাবে মাটি ফেটে চৌচির। মানুষ পশু-পাখি সকলেই ঘেমে নেয়ে একসা। তেষ্টায় ছাতি ফাটছে। সকলেই একটু ছায়া খুঁজছে। কিন্তু ছায়া কোথায় ? শুধুই রোদ আর রোদ। ছায়ার খুব খারাপ লাগলো। সে বলল, “এটা তোর বাড়াবাড়ি হচ্ছে রোদ। সবাই খুব কষ্ট পাচ্ছে। তুই সরে যা।''
রোদ গেল রেগে। বলল, “এ আবার কেমন আবদার! গরমকালে রোদ থাকবে না ? বর্ষার সময় তুই যে মেঘের ছায়া দিয়ে সবকিছু ঢেকে রাখিস তার বেলায় ?''
ছায়া বলল, “তাতে তো কারো কষ্ট হয় না।''
রোদ বলল, “আলবাত কষ্ট হয়। চারিদিকে স্যাঁতস্যাঁতে, ভিজে ভিজে হয়ে থাকে। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। সবাই তখন একটু রোদ চায়।''
ছায়া কটমট করে বলল, “তা হোক, রোদের মতো কষ্ট তো আর হয় না। তুই সরে যা। আমি এখন সবাইকে ছায়া দেব।''
রোদ একটু চুপ করে থেকে অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “ঠিক আছে আমি চললাম, কোনদিন আর আমায় পাবি না। বিপদে পড়ে ডাকলেও আসব না।''
ছায়া বলল, “দূর, রোদ না থাকলে আবার বিপদ কিসের। বরং ভালই হবে। সবাই আমায় নিয়ে আনন্দে থাকবে।''
রোদ বলল, “তবে তাই হোক।'' কথাটা বলে রোজ সত্যি সত্যি বিদায় নিল।
ছায়া পেয়ে মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, নদী-নালা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
কিন্তু বিপদ এল বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। শীতকালে। উত্তুরে বাতাস ছুটে আসছে পাহাড় থেকে। শীতে জুবুথুবু অবস্থা। সবাই ঘরে ঢুকে জানলা দরজা বন্ধ করে হিহি করে কাঁপছে। সোয়েটার, টুপি, মাফলার, লেপ-কম্বল কোনো কিছুতেই ঠাণ্ডা বাগ মানতে চায় না। বাইরের কাজকর্ম বন্ধ। নদীর জলে বরফ ভাসছে। গাছের পাতা পড়ে গেছে সব। একটু রোধের জন্য সবাই প্রার্থনা করছে। কিন্তু রোদ আর কিছুতেই ফিরছে না। ফিরবে কেন ? তার যে রাগ হয়েছে। সবাই ধরল ছায়াকে। ছায়া ছুটল বন্ধুর কাছে। পাকা পেয়ারা, ক্রিকেট ব্যাট, ডজনখানেক স্টাম্প, সৌরভ গাঙ্গুলীর ছবির পোস্টার, একটা কমিকসের সিডি দিয়ে রোদের রাগ ভাঙ্গালো। বলল, “প্লিজ ভাই একবার চল। রোদ ছাড়া যে আর বাঁচা যাচ্ছে না। সবাই তোর কথা বলছে। তোকে চাইছে। ঠাণ্ডায় খুব কষ্ট পাচ্ছে সবাই।''
মুচকি হেসে রোদ ছায়ার হাত ধরে রওনা হল। হাড় কাঁপুনি ঠাণ্ডা থেকে সবাই বাঁচলো। সবাই বুঝল রোদ আর ছায়া তুই দুষ্টু ছেলেকেই সবাই খুব ভালোবাসে। দু'জনকেই খুব দরকার। কারো ওপরেই বেশিক্ষণ রাগ করা উচিত নয়।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪১৯
0 মন্তব্যসমূহ