Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

মনের কোণে ।। ঝিমলি মুখার্জি পাণ্ডে



রাজুর আজ মন খারাপ। রাজু অর্থাৎ দশ বছরের সৌম্য। অহিন্দ্র চন্দ্র বসু মেমোরিয়াল হাইস্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্র সে। কোলাঘাটের কাছে নিশ্চিন্দা গ্রাম, সেখানেই তার বাড়ি, আর মাইলটাক হেঁটে গেলে তার স্কুল।

আজ রবিবার। স্কুল ছুটি, তাই রাজুর দিনটার মধ্যে রোজকার ব্যস্তাতাটা নেই। এটা তাকে যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই আবার রবিবারটা শেষ হয়ে যাবার ভয়টাও মনের মধ্যে ঢোকে। সোমবার থেকে আবার বাঁধা রুটিন শুরু হয়ে যায় সেই ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে।

আর কাল থেকে তো স্কুলে যাওয়াটা আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। কেই বা ইংরাজি বাক্য রচনা করবার সময় সাহায্য করবে আর কেই বা অঙ্ক থাতা জমা দেওয়ার আগে ভুলগুলো শুধরে দেবে ? প্রাণের বন্ধু অনিমেষ যে কলকাতা চলে গেল!

কী রে ? এখানে দাঁড়িয়ে আছিস, এত সকালে ?”

মা। কোনো কাজ মনে পড়েছে তাই একতলা থেকে উঠে এসেছেন।

বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে ?” মা আবার জিজ্ঞেস করলেন।

না এমনি।রাজু অন্যমনস্কভাবে উত্তর দেয়।

কখন উঠেছিস ?”

অনেকক্ষণ ।

নীচে যাসনি কেন ?”

এই তো যাচ্ছিলাম।

এই বললি অনেকক্ষণ উঠেছিস! সেই তখন থেকে ঠায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছিস ?”

রাজু চুপ করে থাকল। কী বলবে ? অনিমেষ চলে গেছে বলে তার রবিবার আর বাকি সব বারগুলোই এখন বরবাদ হয়ে গেছে ? সবাই হাসবে যে!

অনিমেষরা চলে গেছে বলে তোর মন খুব খারাপ, না রে রাজু ?”

মা কি মনের কথা পড়তে পারে নাকি ? রাজু অবাক হল। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। গলা দিয়ে এক দলা কান্না উঠে আসছে কিন্তু সে জোর করে সেটাকে গিলতে চেষ্টা করল।

মা, বেছে বেছে আমার বন্ধুকেই কেন চলে যেতে হল, বলতো ?”

কী করবে বাবা, ওর বাবার বদলির চাকরি যে। তাও তো এবারে অবনীবাবু পাঁচ বছর এক জায়গায় ছিলেন! তাই তো তোরা এ ক-বছর একসাথে কাটাতে পারলি।

ও তো আমাদের বাড়িতে থাকতে পারত!

সে কি রে! ও বাবা-মাকে ছেড়ে থাকবে কি করে ? তুই পারতিস ?” বলে মা বুকের কাছে টেনে নিলেন রাজুকে।একটু জেদি আর একগুঁয়ে তাঁর এই ছোটো ছেলে, কিন্তু অনিতা জানে যে রাজু এমনিতে ডাকাবুকো হলেও বড়ো আবেগপ্রবণ।

প্রায় জোর করে ছেলেকে নীচে নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দাঁত মাজিয়ে, মুখ ধুইয়ে জলখাবার খেতে বসালেন অনিতা। সাধারণত ছটা ফুলকো লুচি খায় রাজু। নিমেষে উড়ে যায় প্লেট থেকে। আজ দুটো দিয়ে ছেলেকে প্রথমে বসিয়েছিলেন। তারপর তিন নম্বর লুচিটা খুন্তির ওপর ব্যালেন্স করে তড়িঘড়ি নিয়ে এসে অনিতা দেখেন যে রাজু এখনও প্রথমটাকে নিয়েই নাড়াচাড়া করছে।

সর সর আমি খাইয়ে দিচ্ছি। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর ভালো লাগবে না, চামড়া হয়ে যাবে, একে ময়দার জিনিস,” বলে অনিতা ব্যস্ত হলেন ছেলেকে খাওয়াতে।

খানিকক্ষণের মধ্যে রাজুর বাবা, সৌগত এসে খাবার টেবিলে বসলেন। হাতে খবরের কাগজ, তাতে শব্দসন্ধান খোলা। তিনি ব্যস্ত ডাক্তার এবং অন্যান্য দিন চেম্বার সেরে বাড়ি ঢুকতে বেশ রাত হয়। রবিবার দিনই সৌগত রায় ছেলের খবরাখবর নিতে পারেন বা তার সাথে গল্প করতে পারেন।

কী হে ক্যাপ্টেন! নিজে হাতে খেতে ইচ্ছে করছে না বুঝি ? বন্ধুরা যদি একবার জানতে পারে না ... !

অন্যদিন হলে বাবার এই পিছনে লাগায় রাজু রাগ করত। কিন্ত আজ মুখে লুচি নিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে রইল যেন কিছুই হয়নি।

বাব্বা! এ যে দেখছি ম্যাচিওরড বয়! চেনা যাচ্ছে না। কী বল অনিতা ?”

ছেড়ে দাও। আজ আর ওর পেছনে লেগো না। বেচারার মন খারাপ। ওর প্রাণের বন্ধু অনিমেষ কলকাতায় চলে গেছে।

ও হো! হ্যাঁ জানি তো, অবনীবাবু ট্রান্সফার হয়েছেন ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের শিয়ালদা শাখায়। সত্যিই তো বন্ধুর জন্যে মন খারাপ হবে না ?”

আজ চলো, সন্ধেবেলা আমরা একটু কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি। রাজুর তাহলে ভালো লাগবে।অনিতা প্রস্তাব দেন।

হ্যাঁ চলো না! আমরা দেউলটি যাই। মা-র সাথে প্রায় এক মাস দেখা হয়নি। বাবুয়ার শরীরটাও ভালো নেই।

না মা, আজ কোথাও যাব না, অনেক হোমটাস্ক আছে, শেষ করতে হবে।

বাবা-মা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। অন্যান্য রবিবারগুলো হয় রাজু অনিমেষের বাড়ি আর নয়তো অনিমেষ রাজুর বাড়িতে হুটোপাটি করে কাটাত। বকাবকি করে পড়াতে বসাতে হত দুজনকে। তবে অনিমেষ লেখাপড়ায় ভালো আর রাজুকেও যথেষ্ট সাহায্য করত।

কী রে ? সরলের অক্কগুলো করেছিস তো ?” চমকে উঠল রাজু। সে মধুসূদন স্যারের দেওয়া সরলগুলোই করছিল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল; কেউ কোথাও নেই। ঠিক মনে হয়েছিল যেন অনিমেষের গলা। খাতাটা বন্ধ করে দিল রাজু। ব্রাউন পেপারে মলাট দেওয়া খাতার ঠিক মাঝখানে নাম লেখার স্টিকারে লেখা আছে সৌম্য মুখার্জি, ক্লাস ফাইভ, সেকশন '। অনিমেষের হাতের লেখা ভালো বলে সেই দুজনের বই খাতায় নাম লিখে দিত বছরের শুরুতে। সোমবারের রুটিন বার করে বই-খাতা গুছিয়ে নিতে শুরু করল রাজু।

কী রে? আজ তো একা বসতে হবে!ক্লাসে ঢুকতে ঢুকতে অলোক ব্যঙ্গ করল রাজুকে।

হ্যাঁ, আজ ওর প্রাণের বন্ধু নেই, আমাদের সাথেই খেলতে হবে,” মণীশ গলা জুড়ে দিল।

আাই ওরকম বলছিস কেন ? সৌম্য তো সবার সাথেই মেশে। হ্যাঁ অনিমেষ ওর সব থেকে প্রিয় বন্ধু ছিল। সে তো হতেই পারে,” প্রবাল বলে ওঠে।

তুই আর ওর হয়ে পোঁ ধরিস না প্রবাল। অনিমেষ আমাদের কোনোদিন ইংরেজি বাক্য রচনাগুলো দেখিয়ে দিত না। কিন্তু সৌম্যকে নিজের খাতা অব্দি বাড়ি নিয়ে যেতে দিত।

তোরা কি কখনও চাইতিস ? অনিমেষ যথেষ্ট সাহায্য করত সবাইকে। ফার্স্ট বয় বলে ওর কোনো গর্ব ছিল না,” প্রবাল আবার বলে।

হ্যাঁ, তুই তো বলবিই, তুই তো ক্লাসের গুড বয়। তোদের মধ্যে কেন যে সৌম্য ঢুকেছিল কে জানে!

তোরা হঠাৎ ওর পিছনে লাগছিস কেন বলতো? দরকারের সময় তো সেই সৌম্য ছাড়া গতি নেই কারুর!

তর্কটা বেঁধে ওঠার আগেই মধু স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। মধুসূদন তরফদার, অঙ্কের টিচার। রাশভারী চেহারা আর স্বভাবের এই স্যারকে সবাই ভয় পায়। অন্যান্য টিচাররাও বেশ সমীহ করে চলেন।

আজ এমনিতেই ভয়ের দিন। সোমবার ফার্স্ট পিরিয়ডে অঙ্কের ক্লাস থাকলে, স্যার বোর্ড-এ অঙ্ক লিখে দেন এবং যে কোনো একটি ছেলেকে ডেকে নেন, অক্কটি করার জন্য। না পারলেই বকাঝকা, ইডিয়ট, স্টুপিডের বন্যা। স্যার ঢুকতেই সবাই তটস্থ হয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বসল।

আজ আমরা সরলের অঙ্কের অভ্যাস করব। প্রত্যুষ তুমি উঠে এসো। প্রথমে বোর্ডে এই অঙ্কটা লেখ, তারপর এর সমাধান করো।স্যার অঙ্ক লেখা কাগজটি বাড়িয়ে দিলেন। প্রত্যুষ বলে ছেলেটি সম্তর্পণে কাগজটা খুলে ভয়ে ভয়ে চোখ বুলিয়ে বন্ধুদের দিকে পাংশু মুখে তাকিয়ে নিল।

যাও! দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছ কেন ?” মধু স্যারের গলায় কড়া নির্দেশের সুর। ক্লাসের অনেকের মতো রাজুর বুকেও তখন হাতুড়ি পিটছে। সে অঙ্কে একেবারেই কাঁচা। অনেক প্র্যাকিটস করে আার আনিমেষের তাড়া খেয়ে এতদিন কোনোমতে পাশ করছিল। কিন্তু এবার ?

হারি আপ! অক্কটা লিখে দাঁড়িয়ে আছ কেন ? গত এক মাস ধরে সরল করেও তোমার মোটা মাথায় এর সহজ নিয়মটা ঢুকল না ?” হুঙ্কার  ছাড়লেন মধু স্যার।

প্রত্যুষ এমনিতেই ফর্সা, এখন একেবারে ফ্যাকাশে মেরে গেছে। সে বেচারি অঙ্ককে যমের মতো ভয় পায়। বোর্ডের সামনে গিয়ে ভালো ছেলেদেরই মাথা গুলিয়ে যায়! প্রত্যুষ খানিকক্ষণ ধরে কয়েকটা সংখ্যা লিখল মাত্র।

যাও! ক্লাসের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। সৌম্য উঠে এসে অঙ্কটা করো।

ফাঁসিকাঠের আসামির মতো রাজু গিয়ে প্রত্যুষের হাত থেকে চকটা নিল।

কোন ব্র্যাকেটের পর কোন ব্র্যাকেট মনে রাখার জন্য একটা ছোট্ট মন্ত্র আছে। মনে আছে তো ? ”কে বলল ? ঠিক যেন অনিমেষের গলা। সেই কাল সন্ধের মতো আবার চমকে উঠল রাজু। তারপর বোর্ডের কাছে গিয়ে খস্‌ খস্‌ করে লিখতে শুরু করল।

বাঃ! এই তো হয়েছে। সৌম্য তুমি অঙ্ক প্র্যাকটিস করছ দেখছি।মধু স্যারের প্রশংসায় রাজু সম্বিত ফিরে পেল। সত্যিই তো অঙ্কটা হয়ে গেছে! চকটা স্যারের টেবিলে রেখে অন্যমনস্কভাবে ধীরে ধীরে সে নিজের জায়গায় ফিরে গেল।

স্যার ভেবেছিলেন আজকেও তুই পারবি না। বেছে বেছে তো অঙ্কে কাঁচাদেরই ডেকে নেন, বকা দেবার জন্য,” পিছন থেকে ফিশ ফিশ করে নিলয় বলল।

চুপ চুপ। কথা বললেই স্যার তাকাবেন, আর অঙ্ক করতে ডাকবেন।অসীম মাথা নীচু করে যতদূর সম্ভব কুঁজো হয়ে রাজুর পিছনে লুকিয়ে থাকে, স্যারের চোখে চোখ পড়ে যাবার ভয়ে।

ঘন্টা পড়ার পরে সবাই হাঁপ ছাড়ে। এমনটাই হয় প্রতিদিন। কিন্তু আজ বেশ কয়েকটি ছেলে এসে রাজুকে ঘিরে ধরে।

তুই তো ভেলকি দেখিয়ে দিলি রে, সৌম্য! অত শক্ত অঙ্ক একবারে খস্‌ খস্‌ করে করে দিলি ? স্যারও নিশ্চয়ই এতটা আশা করেননি।

রাজু চুপ করে রইল। সে নিজেই খানিকটা অবাক হয়ে গেছে। এতটা কি কেউ আশা করে ? এ যেন সত্যিই ম্যাজিক। দেখা যাক কাঞ্চন স্যারের ক্লাসে কী হয়!

ইংরেজির শিক্ষক কাঞ্চন মল্লিক, এমনিতে শান্ত স্বভাবের, কিন্তু পড়া না পারলে গার্জেন কল করা তার একটা বাতিক। আর গার্জেন কল মানেই বাড়িতে বকা-ঝকা, মার, খেলায় বাধা আরো কত কী।

আজ আমাদের প্যারাগ্রাফ লিখতে দেবেন স্যার। কত যে মুখস্থ করেছি, কিন্তু তাও সব ভুল হয়ে যাচ্ছে,” মণীশ বলে।

আ্যাই প্রবাল, চটপট লিখে নিয়ে খাতাটা পিছনে দিয়ে দিবি। তুই আবার ইংরেজ, একটাও ভূল করিস না,” অলোক অনুরোধের সুরে বলে।

একটা আধটা শব্দের উত্তর খাতা দেখে টোকা যায়। গোটা প্যারাগ্রাফ কী করে টুকবি ?” প্রবাল জিজ্ঞেস করে।

তুই দিয়েই দেখিস ন| !” মণীশ বলে।

আমার এই ইংরেজির এক বচন-বহু বচন, অতীত-বর্তমান কাল, সব গণ্ডগোল হয়ে যায়।

রাজু আজ এই আলোচনায় মন দিতে পারছে না। অন্যান্য সময়ে সেও ইংরেজির বিরুদ্ধে দু-কথা শুনিয়ে দিত, বিশেষ করে অনিমেষকে। ইংরেজিতে অনিমেষ এত ভালো ছিল যে তার একটাও ভুল স্যারেরাও ধরতে পারতেন না।

কাঞ্চন স্যার পুজো নিয়ে একটা প্যারাগ্রাফ লিখতে দিলেন। সময় দিলেন কুড়ি মিনিট। তারপরে স্যার যাকে যাকে বলবেন, তাদের খাতা নিয়ে গিয়ে তাঁকে দেখাতে হবে। বাকিরা খাতা জমা দিয়ে দেবে।

আই অ্যাম, আই হ্যাব, ইউ আর, হি ইজ... নিয়মগুলো পরপর মাথায় রাখ।রাজু এবারে আর চমকালো না। সে যেন এবারে কান পেতেই ছিল।

দুর্গা পূজা ইজ মাই ফেভারিট ফেস্টিভাল ..." রাজু স্পিডে লিখে চলল।

আই ফিল স্যাড হোয়েন দ্য পূজা গেট্স ওভার অন দশমী, আ্যান্ড ওয়েট ফর দ্য নেক্সট পূজা টু কাম।রাজু প্যারাগ্রাফ শেষ করল। তারপর মাথা তুলে দেখল যে বাকিরা তখনও লিখছে। পিছনে ফিস ফাস চলছে। এমনকি প্রবালেরও তখনও শেষ হয়নি। রাজু দাঁড়াল। তাকে দেখে স্যার খানিকটা অবাকই হলেন। তারপর বাঁকা হেসে খাতাটা টেনে নিলেন।

হুমূম্‌...! বেশ লিখেছ তো ?” মোটা কালো ফ্রেমের চশমার ওপর দিয়ে কাঞ্চন স্যার রাজুর দিকে দেখলেন। সে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে রইল।

বানানগুলোও ঠিকঠাক আছে দেখছি। আগে এত ভুল হত কেন ?” স্যার খাতার আগের পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখলেন।

তোমার বন্ধু অনিমেষ তো কলকাতায় চলে গেছে তাই না ?”

হ্যাঁ, স্যার ।

ওখানে কোন স্কুলে ভর্তি হল ?”

হিন্দু স্কুলে স্যার। আজই হবার কথা।

বাঃ! হিন্দু তো নামকরা স্কুল। অনিমেষ খুব ভালো ছাত্র ছিল। আমি অন্তত ওকে ক্লাসে খুব মিস্‌ করব। ওর সাথে কথা হবে তোমার ?”

হ্যাঁ স্যার! আজ সন্ধেবেলা ফোন করব, কাকুর মানে অনিমেষের বাবার মোবাইলে।

বোলো যে কাঞ্চন স্যার খোঁজ নিচ্ছিলেন।

বলব স্যার ।

আর এটাও বোলো যে ও যেন সাহস করে সব ব্যাপারে এগিয়ে যায়। মুখচোরা লাজুক ছেলে কিন্তু কলকাতায় অচল।

বলব স্যার ।

ওর বাবার নম্বরটা আমায় দিও। কথা বলব ওর সাথে আর কলকাতায় গেলে দেখাও করব।

দেব স্যার।

কথার মাঝে খেয়াল করেননি যে সবার লেখা হয়ে গেছে আর খাতা বন্ধ করে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

আরে তোমরা বলবে তো! যা তো সৌম্য খাতাগুলো নিয়ে আমায় স্টাফরুমে পৌঁছে দিস।স্যার ঘড়ির দিকে তাকালেন আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে টিফিনের ঘন্টা বাজল।

স্টাফরুম থেকে ফিরে এসে রাজু দেখল ক্লাস প্রায় ফাঁকা। নিজের টিফিনটা বার করে নিয়ে সেও চলল খেলার মাঠের দিকে। অন্যদিন হলে সে আর অনিমেষ চলে যেত একেবারে গোলপোস্টের পেছনের আমগাছটার নীচে। সেখানে রাহুল, প্রবাল আর সায়ন্তনও জুটত। সবাই মিলে টিফিন ভাগ করে খাওয়া হত। আবার অনিমেষের জন্য মনটা কেমন করে উঠল রাজুর।

আরে মন খারাপ করিস না। দ্যাখ কাকিমা নিশ্চয়ই ভালো টিফিন দিয়েছেন।

হ্যাঁ দেখব। তুই যা তো!

রাজু এবারে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে যে যখনই গলাটা কানে কানে ফিস ফিস করবে, তখনই সেও ফিস ফিস করে উত্তর দেবে।

আরে কী বিড় বিড় করছিস রে ?” প্রবাল এগিয়ে এল।

অ্যাঁ কই ? না তো ?”

আমি স্পষ্ট শুনলাম। যাক গে আমরা তোর জন্যেই অপেক্ষা করছি। আগে খেয়েনি তারপর তোকে একটা জিনিস দেখাব ।

আচ্ছা চল।

ওরা আমগাছের ছায়ায় গোল হয়ে বসে খেতে লাগল পাঁচ ছয়জন মিলে। ঝলমলে রোদ চারিদিকে। আকাশ ঝকঝকে নীল, পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভাসছে। ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া, মনোরম শরৎকালের ছোয়া চারিদিকে। আর কিছুদিনের মধ্যেই পুজোর ছুটি পড়ে যাবে স্কুলে। কে কোথায় বেড়াতে যাবে এই নিয়েই সবাই আলোচনা করছে টিফিন খেতে খেতে। টিফিন খুলেই রাজুর মনটা খুশিতে ভরে উঠেছে। মা লুচি আলুভাজা আর চন্দ্রপুলি সন্দেশ দিয়েছেন। লুচি রাজুর প্রিয়, কিন্ত টিফিনে ঠাণ্ডা লুচি খেয়ে যদি তার শরীর খারাপ হয়, সেই ভয়ে মা দেন না। রাজু বুঝল মা তাকে খুশি করার জন্য ভালো টিফিন দিয়েছেন।

কটা লুচি আছে রে ? আমায় একটা দিবি ?” সায়ন্তন চাইল।

নে না, মা বেশি করেই দিয়েছে।

কেউ নাড়ু খাবি ?” বলে প্রবাল এগিয়ে দিল আর নিমেষে পটাপট করে সবাই একটা করে তুলে নিল।

চল চল, এবার রাজুকে সেই জিনিসটা দেখাতে হবে, ও ছাড়া কেউ পারবে না।” “কী রে ? কী দেখাবি ?”

আরে চল না।

সবাই মিলে স্কুল বাড়ির ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। রাহুলই প্রথম দেখতে পেয়েছিল ডিম দুটো।

পাছে কেউ মাড়িয়ে দেয় তাই এই ফুলের টবে ঢুকিয়ে রেখেছি।সায়ন্তন বলল।

কীসের ডিম রে ?” রাজু ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে।

মনে হয় পায়রার। ওই দোতলার ক্লাসরুমের জানলার ছ্যাঁচাটা দ্যাখ ওখানে একটা পায়রার বাসা দেখেছিস ? মনে হয় ওখান থেকেই পড়েছে।প্রবাল বলে।

আমাদের কারুর তো সাহস হচ্ছে না অত উঁচুতে উঠে ডিম দুটো ফিরিয়ে দিতে। তুই পারবি ? তুই তো আমাদের ক্লাসের সব থেকে সাহসী ছেলে, সৌম্য।রাহুল সকলের হয়ে অনুরোধ করল।

ততক্ষণে ওদের জটলা দেখে ক্লাসের অন্যান্য ডাকাবুকো ছেলেগুলো অর্থাৎ মণীশ, অলোক এরাও জুটে গেছে।

পাম্প ঘরে একটা মই আছে আনব ?”

হ্যাঁ হ্যাঁ চল চল। তাতে সুবিধে হবে।

দরকার নেই। দাঁড়া।রাজু বলে। সত্যিই তার দুর্জয় সাহস। সেবার হেড স্যারের হাত থেকে চশমা জানলা গলে তাঁর দোতলার ঘরের ঠিক নীচে, টালির চালটার ওপরে পড়েছিল। সেও বারান্দা দিয়ে হাল্কা পায়ে নেমে, সৌম্যই উদ্ধার করেছিল। একবার স্কুলের ঠিক বাইরে একটা ভিখিরিকে চাপা দিয়ে একটা মালভর্তি ম্যাটাডোর পালাচ্ছিল। সৌম্য ব্যাগ ফেলে দিয়ে স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে ড্রাইভারের পাশের দরজা দিয়ে ঝুলে পড়ে তাকে গাড়ি থামাতে বাধ্য করে। সাঁতারে সৌম্য এতই ভালো যে কোলাঘাটের রূপনারায়ণ, বর্ষাকালে বাবার সাথে এপার-ওপার করতে পারে। তাই পড়াশোনায় একটু অমনোযোগী হলেও স্যারেরা তাকে খুবই ভালোবাসেন।

আমি আগে একতলার ছ্যাঁচাটায় উঠে দেখি। যদি বাথরুমের পাইপের গায়ে লাগানো লোহার রিংগুলো বেয়ে উঠে যেতে পারি তাহলে দোতলার জানলার গ্রিল অবধি পৌঁছতে অসুবিধা হবেনা।

চিন্তা করিস না বস্। পা স্লিপ করলে আমরা ধরে নেব।অলোক পুরানো রেষারেষি ভুলে রাজুকে আশ্বাস দেয়।

নিমেষে রাজু একতলার জানলার ছ্যাঁচায় উঠে পড়ল। তার প্যান্টের দু-পকেটে ডিম দুটো। আর নীচে বন্ধুরা তুমুল উৎসাহে হাততালি দিয়ে উঠল।

অ্যাই! তোরা সবাই এখানে জড় হয়ে কী করছিস রে ?” গম গম করে উঠল হেডমাস্টার অতীন গুহ-র গলা।

সর্বনাশ, হেড স্যার।

পালাস না, দাঁড়া।

প্রবাল এগিয়ে গিয়ে স্যারকে ঘটনাটা বলল।

ও আচ্ছা! তাই নাকি? বেচারা পাখি মা-র খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সৌম্য ছোটো ছেলে। পারবে ?”

স্যার আপনি জানেন ওকে। পারলে ওই পারবে।

তা বটে। কী রে পারবি ? না রামখিলানকে বলব মই নিয়ে এসে উঠতে ?”

চিন্তা নেই, স্যার! পেরে যাব মনে হচ্ছে।

দ্যাখ, সাবধানে কিন্তু। আমি দাঁড়িয়ে রইলুম এখানে।অতীনবাবু উৎসাহে-উৎকণ্ঠায় প্রায় এক নিমেষে সৌম্যদের বয়সে পৌঁছে গেছেন। টিকটিকির মতো সৌম্য জলের পাইপ বেয়ে সরসর করে উঠতে লাগল।

আর একটু; তারপরেই পায়ে টিপ দিয়ে ব্যালেন্স রেখে হাত বাড়িয়ে দোতলার জানলার গ্রিল ধরে ফেলল। তাকে এত কাছাকাছি আসতে দেখে ফড় ফড় করে বাবা-মা পায়রা উড়ে গেল। টিফিন শেষের ঘন্টাও পড়ে গেল। কিন্ত এখন কারুর এখান থেকে নড়ার প্রশ্নই ওঠে না।

গ্রীল বেয়ে আবলীলায় উঠে গিয়ে পকেট থেকে ডিম দুটো বার করে সৌম্য পায়রার বাসায় ঢুকিয়ে দিল। নীচে তুমুল হাততালি আর উচ্ছাসের রোল উঠল। ততক্ষণে অন্যান্য টিচার এবং বড়ো ছেলেরাও জড়ো হয়েছে সেখানে।

নীচে নামতেই তাদের মধ্যে একজন কাঁধে বসিয়ে নিল রাজুকে। সে এক দারুণ ব্যাপার। রাজুও ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে। এতক্ষণে যেন তার মনটাও খানিকটা হালকা হয়েছে।

চল চল, তোরা সবাই মিষ্টি খাবি। অতীনবাবু পা বাড়ালেন, পেছনে বিজয়ী ফুটবল টিমের মতো বাকি সকলে।

সন্ধেবেলা রাজু মা-র থেকে মোবাইল ফোনটা চেয়ে নিয়ে অনিমেষকে ফোন করতে যাবে, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল।

সৌম্য ...! ভালো আছিস ?” ওপার থেকে অনিমেষের গলা ভেসে এল।

হ্যাঁ রে, তুই ?”

আমি ভালোই আছি। তোদের সবার কথা খুব মনে পড়ছে।

হ্যাঁ আমার-ও রে, কেমন একসাথে ছিলাম মজা করে-

স্কুল গেছিলি ? কেউ আমার কথা জিজ্ঞেস করছিল ?”

সবাই। স্যারেরাও। তোকে অনেকেই ফোন করবে।

হ্যাঁ। তাহলে খুব ভালো লাগবে।

তুই স্কুলে ভর্তি হলি ?”

হ্যাঁ। আজ হলাম।

পরীক্ষা নিল ?”

বাবা ভেবেছিল নেবে, কিন্তু ওরা আগের স্কুলের রেজাল্ট দেখে বলল যে স্যারেরা একটু গল্প করবেন আমার সাথে। আর তারপর ঠিক করবেন আমি ভর্তি হব কি না। আমার যা ভয় করছিল না!

ভয় পাসনি তো ? তুই তো আবার মুখচোরা। একটা উত্তর দিতে আধঘন্টা দেরি করিস।

আরে না না। এত বছর তোর সাথে থেকে থেকেও কি খানিকটা বদলাব না নাকি ?”

তারপর কী হল বল।

নতুন জায়গা, একেবারে কলকাতা শহরের বুকে কলেজ স্ট্রিটের ওপর বিরাট স্কুল রে! কয়েক হাজার ছেলে পড়ে। গম গম করছে চারিদিক। এ সব দেখে-শুনে বুক টিপ টিপ করছিল

দূর বোকা! বুক টিপ টিপ করার কী আছে ? ওঁরা ভালুক নাকি ?” “তা না হোক। কী সব স্যার রে! তোরও দেখলে ভয় করত।

মোটেও না। স্যাররা কি বেত নিয়ে ঘুরছিলেন যে ভয় করবে ? আর তুই-ও কি লেখাপড়ায় কম যাস নাকি ?”

জানিস কী হল ? স্যারেরা একেবারে গোল করে ঘিরে স্টাফরুমে নিয়ে বসলেন আমাকে। আমার তো হাত পা কাঁপছে তখন ...

তারপর ?”

তারপরই তো হল একটা ম্যাজিক!

কী ম্যাজিক ?” গল্প শুনতে শুনতে সৌম্য একেবারে গল্পের ভেতরে ঢুকে গেছে।

যেই মাথার মধ্যে সব কিছু তালগোল পাকাতে লাগল, মনে হল তুই পিঠে একটা কিল মেরে বললি, “ইয়ার্কি হচ্ছে ? আমাদের স্কুলের নাম ডোবাবি নাকি ?' আর তারপরেই ভয়টা কেমন যেন উবে গেল।

মানে ?” এপাশে সৌম্যও উতকর্ণ।

তবে কী... ?

যখনই একটু ভয় পেয়ে যাচ্ছিলাম তোর চেতাবনি শুনে আবার গড়গড় করে প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলাম। মনে হচ্ছিল তুই অদৃশ্য হয়ে আমার কাছাকাছি রয়েছিস ...

ওপাশে অনিমেষ আরও কত কী বলছিল, কিন্তু সৌম্যর সেদিকে মন নেই। সে ভাবছিল তার নিজের কথা। সেও তো অনিমেষের দেওয়া চেতাবনির জোরে আজ ক্লাসের কাজ ঠিক করে করতে পেরেছিল।

কিন্ত এত কথা কি ফোনে বলা যায় ? দেখা হলে বলবে যে তারা দুই বন্ধু যত দূরেই থাক টেলিপ্যাথির জোরে নিমেষে কাছে চলে আসতে পারে। গত সপ্তাহে, যখন অনিমেষদের জিনিসপত্র বাঁধাছ্যাঁদা হচ্ছে, তখনই তো টিভিতে এই টেলিপ্যাথি নিয়ে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। সোফায় বসে কথার ফাঁকে ফাঁকে, এই অনুষ্ঠানটা দুজনেই দেখেছিল কিন্তু তার মানে তখন ভালো বোঝেনি।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া- ১৪১৯

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ