কত হাসি-কান্না দুরন্তপনা খুনসুটি হুটোপুটি
দুষ্টুমিতে ভরা আমাদের ছেলেবেলা। জীবনের
এই সময়টি পেরিয়ে এসে যাঁরা অনেক বড়ো হয়ে যান, তাঁদের ছেলেবেলার কথা কার না জানতে ইচ্ছে করে।
সেইসব বড়ো মানুষদের সেরা সময়ের গল্প কথাই দলিল করে হয়ে উঠেছে এই বিভাগে-
জমিদারের কাজে বেশ কিছুকাল ছিলেন
শিলাইদহে। প্রজাদের সঙ্গে তার খুব ঘনিষ্ঠ
সম্পর্ক ছিল। প্রজাদের কেউ হিন্দু,
কেউ মুসলমান। সকলের সঙ্গেই সহজভাবে মিশতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা তাদের
সঙ্গে গল্প করতেন। শুনছেন তাদের
দুঃখ-কথা। গরিব চাষিদের কেউ
কলাই সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটায়,
কেউ একজনের ভাত তিনজনে
ভাগ করে খায়। এসব তাকে কষ্ট দিত। মন খারাপ হয়ে যেত।
শিলাইদহে বসবাসকালে পদ্মায় ঘুরে বেড়াতেন বজরায়। একবার খুব বিপদে পড়েছিলেন। বটে তিনি একা ছিলেন না, ছিল পুত্র-কন্যারা। হঠাৎই তুমুল ঝড় ওঠে, ঝড়ের সঙ্গে আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। এলোমেলো বাতাসে নৌকো কাত হয়ে যায় যায়। বরাত ভালো, শেষ পর্যন্ত ডোবেনি। নৌকোর মাঝিরা ছিল অভিজ্ঞ, কোনরকমে চরে বেঁধে রাখে তারা।
রাত কেটে ভোর হয়। আবহাওয়া আগের দিনের থেকে সামান্য ভাল হলেও দুর্যোগ তখনও কাটেনি। তবুও মাঝি-মাল্লারা নৌকা বাইতে শুরু করে। কিছুদুর যাওয়ার পর আকাশের অবস্থা একেবারে বদলে যায়। চারপাশ ঘন অন্ধকার হয়ে আছে। শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। মাঝিরা নৌকো তীরে নিয়ে আসে, চলে অপেক্ষা। খানিক পরে ঝড় বৃষ্টি থামে। মাঝিরা খুশি, শুরু করে আবার নৌকা বাওয়া।
বোটের ছাদে উঠে তিনি দেখছিলেন প্রকৃতির রূপ বদল। খানিক আগেই ঝড়-বাদল, এখন কেমন রোদ ঝলমল। হঠাৎ চোখে পড়ে, অদূরেই কে যেন মরে পড়ে রয়েছে। একটু পরেই বুঝলেন, লোকটি মরা নয়। হাত-পা নাড়াবার চেষ্টা করছে। তখনই মাঝিদের ডাকলেন, বললেন, ওকে নিয়ে এসো।
তারা দৌড়ে গেল, নিয়ে এলো বজরায়। পরীক্ষা করে দেখলেন, যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই। তখনো লোকটির প্রাণ আছে। শখ করে হোমিওপ্যাথির চর্চা করতেন অসুস্থ লোকটির চিকিৎসা শুরু করলেন। ওষুধ খাওয়ালেন, গরম দুধ খাওয়ালেন। কিছুক্ষণ পরেই উঠে বসল সে।
জানা গেল, লোকটি এক নৌকোতে কাজ করতো। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাবুরা ভাবে কলেরা হয়েছে, অবস্থা সঙ্গীন দেখেই তারা তাকে ফেলে রেখে গেছে।
লোকটির মুখে একথা শুনে তিনি আবার পরীক্ষা করলেন। ভালো করে পরীক্ষা করে আশ্বস্ত করলেন তাকে, বাপু, তুমিতো কলেরার রোগী নও। আগে হয়ে থাকলেও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ, রোগমুক্ত।
লোকটি'ও মনে বল পেল। উঠে বসলো। তার নানা বিষয়ে খোঁজ-খবর নিলেন। কোথায় থাকে, বাড়িতে কে আছে এরপর কি করবে ?
জানা গেল, তার কেউ নেই। একেবারে অসহায়। সব শুনে তিনি বললেন, তুমি আমার কাছে থাকবে।
সে যেন হাতে আকাশ পেল, তার কালো মুখ আলোয় ভরে গেল।
ত্রিবেণী মাঝিকে যিনি সেবায় যত্নে সুস্থ করে তুলেছিলেন, তিনি আর কেউ নন, আমাদের রবীন্দ্রনাথ। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনেক বড়, মানুষ রবীন্দ্রনাথের পরিচয় এমন নানান ছোটখাটো ঘটনার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঘটনা হয়তো সামান্য, ওই সামান্য ঘটনার মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ মানুষ হিসেবেও ছিলেন অসামান্য। ত্রিবেণী মাঝি রবীন্দ্রনাথকে ভীষণ শ্রদ্ধা করত। একটি কথা প্রায়ই বলতো, বাবাই আমার জান, আমি তারপায় মরবো।
রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের যে শাখাতে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। তিনি শুধু কবি নন, কবিতা-গান-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-নাটক কি লেখেন নি তিনি। ছোটদের জন্য লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, নাটক, বহু কবিতা ও ছড়া। শেষ বয়সে অনেক ছবিও এঁকেছেন।
রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে জোড়াসাঁকো। বৈশাখের পঁচিশে, ইংরেজি ৭ মে। মৃত্যু ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ৭ আগস্ট, বাংলা তারিখ বাইশে শ্রাবণ।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদালানে বসত মাধবচন্দ্রের পাঠশালা। সেই পাঠশালাতেই
রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনার সূত্রপাত। ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমির পর কবিকে ভর্তি করা
হয় নর্মাল স্কুলে। স্কুলের মাস্টার মশাই সাতকড়ি দত্ত প্রথম জানতে পারেন বালক রবি
কবিতা লিখতে পারেন। জানার পর থেকে খুবই উৎসাহিত করতেন তিনি। একদিন রবীন্দ্রনাথের
খাতায় লিখে দিলেন-
“ রবি করে জ্বালাতন আছিল সবাই
বরষা ভরসা দিল আর ভয় নাই।”
মাস্টারমশাইয়ের কথামতো পরের দিন আরো দু-লাইন যোগ করে দেখালেন রবীন্দ্রনাথ-
“মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে
এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।”
এই স্কুলে পড়ার সময় এক মাস্টারমশাই অভিযোগ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ নাকি বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর কখনো পেতে পারেন না। পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। শুনে হাসলেন রবীন্দ্রনাথ। অদম্য তার মনের জোর, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা। আবার পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত তিনি। সত্যি সত্যি পরীক্ষার ব্যবস্থা হল। সকলের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ এর উপযুক্ত জবাব দিতে পারবে তো রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ পরীক্ষা দিতে। সুপারিনটেনডেন্ট। এবারও সর্বোচ্চ নম্বর পেলেন তিনি। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, আগামী দিনে তিনি কত বড় হবেন, তাতো জানতেন না ওই মাস্টারমশাই। বাংলা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কে পেতে পারেন। এই বালক রবিই তো বড় হয়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন, এনেছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা।
নর্মাল স্কুলের পর বেঙ্গল একাডেমি ও সেন্ট জেভিয়ার্স এ কিছুকাল পড়ার পর শেষ হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথাগত শিক্ষা লাভ।
স্কুলে নিয়মের বন্ধন, হাজারো বিধি-নিষেধ কোনদিনই রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগতো না। তাই স্কুল যাওয়া বন্ধ করে বাড়িতেই শুরু হয় তার বিদ্যাচর্চা। প্রথমদিকে, কিশোর বয়সে তার কয়েকজন গৃহ শিক্ষক ছিলেন। পরে নিজেকেই নিজে গড়েছেন তিনি। পৌঁছেছিলেন উচ্চতার শিখরে। বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন হাজার ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে, গীতাঞ্জলি গ্রন্থের জন্য।
রবীন্দ্রনাথের তুলনা রবীন্দ্রনাথ নিজেই। রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ কেউ ভারতীয় সাহিত্যে নেই। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, ততদিন থাকবেন রবীন্দ্রনাথ।
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪১৯
0 মন্তব্যসমূহ