Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বন্ধুর জন্যে ।। কার্তিক ঘোষ




ইস্টিশনে পলাশ গাছ বলতে ওই একটাই।

ফুলের দিনে সব্বাই হাঁ করে চেয়ে থাকে গাছটার দিকে।

সত্যি বলতে, জিরাট ইস্টিশনটাও বেশ নিরিবিলি। নবদ্বীপ যাবার দিকে ইস্টিশন লাগোয়া মাত্র একটাই দোতলা বাড়ি। সেই বাড়ির দোতলার ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা বিন্নিটাও এখন ইসকুলে ভর্তি হয়েছে কিছুদিন হল।

আর সেই জন্যেই হয়েছে দারুণ মুশকিল!

পলাশগাছের টুকুক-কুক কিনা বায়না ধরেছে ইসকুলে যাবার। সেই নিয়েই বড্ড ঝামেলায় পড়েছে বেনে বউ।

হ্যাঁ। গোড়া থেকেই ইস্টিশনের ওই পলাশ গাছটাই বেশি পছন্দ বেনে বউটার। কিন্তু বর তো রাজি হচ্ছিল না সহজে। তবু বউটার জন্যই কিনা বাসা বাঁধতে হল গাছটায়। সে জন্যেও অবশ্য বিন্নিদের বাড়ির সব্বাই খুব খুশি।

একে তো হলদে-কালোয় কী সুন্দর দেখতে পাখি দুটো। তার ওপর টুকটুকে লাল ঠোঁট। পা দুটোতেও যেন আলতা পরা। গলার ডাকটাও কী মিষ্টি!

অন্য পাখিরাও খুব হিংসে করে বেনে বউকে। তার ওপর কিনা বাসা বাঁধতে না বাঁধতেই ফুটফুটে একটা বাচ্চা হল ওদের। সে এখন টুকুক-কুক",“টুকুক-কুক" করে ডাকে। ওর গলা শুনেই ঝুল বারান্দায় বেরিয়ে আসে বিন্নি৷ হাত নেড়ে ডাকে।

মা বলে, কাকে ডাকছিস অমন করে ?

বিন্নি বলে, ওই তো, টুকুকটাকে। দেখেছ মা, কী সুন্দর দেখতে হচ্ছে ও!

বেনে বউ পাখির ছানাটার নাম শুনে মা মুচকি মুচকি হাসে।

বিন্নি যেন ওর বন্ধু। ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একাই কত কথা বলে যখন তখন।

বেনে বউটাও সব দেখে। সব বোঝে। কিন্তু ছোট্ট বাচ্চাটাকে কিছু বলতে পারে না। তাছাড়া, দিন দিন যত বড়ো হচ্ছে ততই বায়না বাড়ছে বাচ্চাটার। যখন তখন বাসা ছেড়ে সরু ডালে গিয়ে বসে। হাওয়ায়-হাওয়ায় দিব্যি দোল খায়। মাঝে মাঝেই বায়না ধরে, আমিও ইসকুল যাব মা-

মা-বাবা দুজনেই বোঝায়, পাখিদের তো ইসকুল নেই কোথাও। থাকলে না হয় ভর্তি করে দিতুম তোকে।

তবু বাচ্চাটা বোঝে না।

বিন্নি মাঝে-মাঝে বারান্দা থেকে চ্যাঁচায়- এই টুকুক, আয় না- ছড়া শোনাব তোকে। তোর একটা ছবিও আঁকব খাতায়। দেখবি ?

সত্যি সত্যি একদিন টুকুক-এর একটা রঙিন ছবি এঁকে ফেলল বিন্নি। হলুদে ডুবু-ডুবু একটা পাখির ছানা। চোখে কাজল। ঠোটে যেন লিপস্টিক!

বাবা দেখে বললে, বাঃ! ভালো হয়েছে।

বিন্নি বললে, জানো বাপি- এর নাম টুকুক। ওই যে- পলাশ গাছটায় থাকে।

শুনেই বাবা যেন কেমন একটু থমকে গেল সেদিন। মিলিয়ে গেল মুখের হাসি।

অবশ্য বিন্নি কিচ্ছু বুঝলে না সে সময়।

শুধু ওর মায়ের কাছে কী যেন সব চুপি চুপি করে বলে ফেললে বাবা। মা শুনে চমকে উঠল একটু। তারপর বললে, সেকি! শেষ পর্যন্ত ইস্টিশনের ওই একটাই পলাশ গাছ- সেটাও কিনা থাকবে না! ফুলের দিনে কত ফুল ফোটে বলো! কী সুন্দর লাগে তখন!

-কিন্তু ইস্টিশনের গোটাটাই যে ছাউনি দিয়ে ঢাকা হবে এবার। তাছাড়া- আরও কী যেন বলতে গিয়েও বাবা হঠাৎ থেমে গেল।

মা কথাটা বিন্নিকে আর কিচ্ছু বললে না কদিন। তবু বিন্নি যেন কেমন করে একদিন সব জেনে গেল। জেনেই হইচই ফেলে দিলে ইসকুলের বন্ধুদের নিয়ে।

তখন তো বেনে বউরাও সব জেনে গেল একটু-একটু করে। গাছটাও যেন মুষড়ে পড়ল ভয়ে।

দিনের বেলা চুপটি করে থাকলেও রাতের বেলা চুপি-চুপি কাঁদে। বেনে বউরাও ভোরবেলা উঠে দেখেছে, পলাশ গাছের পাতায়-পাতায় শুধু যেন কান্নার ফোঁটা। রোদ উঠলে চিক-চিক করে।

টুকুক কিচ্ছু বুঝতে পারে না তখনও। শুধু বলে, তোমার কী হয়েছে মা ? কথা বলছ না কেন ? মা মিছিমিছি হাসে। বলে, কিচ্ছু হয়নি তো-

তবু বাবা যে কেন সারাদিন আর বাসায় থাকে না বাচ্চাটা ঠিক আন্দাজ করতে পারে না। মা অবশ্য জানে, আবার একটা বাসা করতে হবে কোথাও। সেখানে হয়তো বসে বসে আর রেলগাড়ি দেখা হবে না ওদের। বিন্নির সঙ্গেও দেখা হবে না সহজে!

কিন্ত কখন যে কী কাণ্ড হবে কে আর বুঝতে পারে আগে থেকে! মানুষই থ হয়ে যায়, তো পাখিরা! ছোট্ট বিন্নিরাই কি না একদিন হই-হই করে সব্বাই এসে পড়ল ইস্টিশনে। এসেই কিনা ঢুকে পড়ল বড়োকর্তার ঘরে।

বড়োকর্তা মানে, সব্বাই যাঁকে ইস্টিশন-মাস্টার বলে খাতির করে। তাকেই কিনা হঠাৎ এসে ঘিরে ধরল ছোটোরা!

উনি তো শুনে থ। ছোটোরা কিনা একটা পলাশগাছকে বাঁচাতে ছুটে এসেছে ইস্টিশনে!এমন ঘটনা ওঁর জীবনে এই প্রথম। তবু কেমন যেন আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন ছোটোদের কাণ্ড দেখে! সত্যি, এরাই হল আসল বন্ধু!

সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি আনতে দিলেন বিন্নিদের জন্যে। তারপর বললেন, না। পলাশ গাছটা যে আর কাটা হবে না এই কথা দিলুম। কেমন ?

শুনে তো ছোটোদের হাততালি আর থামেই না তখন। ...

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪১৯

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ